নারায়ণগঞ্জ জেলার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে পরিচিত সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের সমাধি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশ দিয়ে অগ্রসর হয়ে, মোগড়াপাড়া থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই সমাধি বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাসের অন্যতম প্রতীক। মোগরাপাড়ার মেইন রোড ধরে সাচিলপুর গ্রামের এই স্থাপনাটি দেখার জন্য প্রতিদিনই আগ্রহী দর্শক ও পর্যটকরা ভিড় জমায়। কালো পাথরের সৌন্দর্যে ও প্রাচীন স্থাপত্যের নিপুণ কারুকার্যে গড়া এই সমাধি বাংলার সুলতানি আমলের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পরিচয় বহন করে।
সমাধির স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য
সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের সমাধিটি একটি অনন্য স্থাপত্য নিদর্শন যা কালো পাথর দ্বারা নির্মিত। এটি একটি তিন ধাপ বিশিষ্ট কবর, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ মিটার, প্রস্থ ১.৫০ মিটার এবং উচ্চতা ৯০ সেন্টিমিটার। প্রতিটি ধাপের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা এই সমাধিকে একেবারেই অন্যরকম করে তুলেছে।
প্রথম ধাপটি সাদামাটা পাথরের পাটাতন হিসেবে নির্মিত হলেও, দ্বিতীয় ধাপে অসাধারণ কারুকার্যময় বাক্সের মতো নকশা করা হয়েছে। এখানেই মূল স্থাপত্যের সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। মাঝের ধাপের চারপাশে এক সারি খোপে বিভক্ত কারুকাজ রয়েছে, যার প্রতিটি খোপে একটি করে ভাঁজযুক্ত খিলান দেখা যায়। এই খিলানগুলো অতি সুক্ষ্মভাবে তৈরি করা হয়েছে এবং খিলানের শীর্ষ থেকে ঝুলে থাকা শিকলের ডগায় পদ্ম-দোলক সংযুক্ত রয়েছে, যা পুরো সমাধির সৌন্দর্যকে এক ধাপ বাড়িয়ে তুলেছে। উপরন্তু, তৃতীয় ধাপটি নৌকার ছৈয়ের মতো তৈরি, যা একটি বিরল নকশা। কার্নিশের চারপাশে সূক্ষ্ম অলঙ্করণ এবং ঝুলন্ত ঘণ্টার নকশা স্থাপত্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যকে আরও আলোকিত করে তোলে।
এই ধরনের স্থাপত্য বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি সেই সময়কার স্থাপত্য রীতির একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। সুলতান গিয়াসউদ্দিনের সমাধির কারুকাজে মধ্যযুগীয় ইসলামিক স্থাপত্যের প্রভাব স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। এই নিদর্শনটি বাংলার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অমূল্য অংশ।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ বাংলার ইতিহাসে এক মহান শাসক
সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ বাংলার ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী শাসক ছিলেন। তিনি ১৩৮৯ সালে তাঁর পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর শাসনামল ছিল ২২ বছরের দীর্ঘ এবং তাঁর শাসনকালে বাংলার শিক্ষা, সাহিত্য, চারুকলা এবং সংস্কৃতির চূড়ান্ত বিকাশ সাধিত হয়। তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ ও বিচক্ষণ এক শাসক, যার বিচারব্যবস্থা সমকালে অত্যন্ত প্রশংসিত ছিল।
এছাড়াও, সুলতান গিয়াসউদ্দিনের সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি অনুরাগ তাঁর শাসনকালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। পারস্যের বিখ্যাত কবি হাফিজের সাথে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই বন্ধুত্বের প্রমাণস্বরূপ, বলা হয়ে থাকে যে হাফিজের একাধিক কবিতার অনুপ্রেরণা ছিলেন এই সুলতান।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, ১৪১০ খ্রিষ্টাব্দে এক গুপ্তঘাতকের হাতে তাঁর মৃত্যুর মাধ্যমে তাঁর শাসনের সমাপ্তি ঘটে। সুলতান গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যুর সাথে সাথেই ইলিয়াস শাহী বংশের ক্ষমতার পতন ঘটে এবং বাংলার ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের অবসান ঘটে।
সমাধির গুরুত্ব ও দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিতি
সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের সমাধি শুধু ইতিহাসের একটি অংশ নয়, এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও একটি নিদর্শন। এই সমাধিটি প্রাচীন বাংলার স্থাপত্যশিল্প এবং ধর্মীয় অনুভূতির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রতিদিন বহু মানুষ এখানে এসে এই স্থাপত্যের রূপ ও সৌন্দর্য উপভোগ করেন এবং ইতিহাসের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করার চেষ্টা করেন।
সমাধির কারুকার্য ও নির্মাণশৈলী এক সময়ের সমৃদ্ধ ইসলামিক স্থাপত্যের নিদর্শন বহন করে। প্রাচীন বাংলার শাসকগণ কেবল রাজ্য পরিচালনায় দক্ষ ছিলেন না, তাঁরা শিল্প-সাহিত্যেও অনন্য অবদান রেখেছিলেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিনের সমাধি সেই সময়ের নির্মাণশৈলীর চমৎকার উদাহরণ, যা আজও মানুষকে মুগ্ধ করে।
যাতায়াতের উপায়
সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের সমাধিতে যেতে হলে প্রথমে রাজধানী ঢাকার গুলিস্তান থেকে বাসযোগে মোগরাপাড়া চৌরাস্তা আসতে হবে। সেখান থেকে সিএনজি বা রিকশা নিয়ে সাচিলপুর গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়ে সমাধিতে পৌঁছানো যায়। মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা থেকে সাচিলপুর গ্রামের দূরত্ব প্রায় ৪ কিলোমিটার। যাত্রাপথ সহজ এবং সরাসরি হওয়ায় এটি একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।
কোথায় থাকবেন
সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের সমাধি দেখে সন্ধ্যার আগেই ঢাকা শহরে ফিরে যাওয়া সম্ভব। তবে, যদি আপনি রাতে থাকতে চান, নারায়ণগঞ্জ সদর এলাকায় বেশ কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে যেখানে আপনি থাকতে পারেন। এই হোটেলগুলোতে সহজেই সুলভ মূল্যে থাকার ব্যবস্থা পাওয়া যায়।
কোথায় খাবেন
মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা এবং সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘরের ১ নম্বর গেট সংলগ্ন বেশ কিছু আবাসিক হোটেল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এখানে স্থানীয় ও ঐতিহ্যবাহী খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। আপনি চাইলে কাইকারটেক হাটের বিখ্যাত পুতা মিষ্টির স্বাদও চেখে দেখতে পারেন, যা স্থানীয়দের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
উপসংহার
সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের সমাধি বাংলার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সাক্ষ্য বহন করে। এর স্থাপত্যশৈলী, শিল্পকর্ম এবং ইতিহাস আমাদের অতীতের গৌরবোজ্জ্বল সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যারা ইতিহাস ও স্থাপত্যের প্রতি আগ্রহী, তাদের জন্য এই সমাধি একটি অনন্য দর্শনীয় স্থান।