তালুকদার বাড়ী

তালুকদার বাড়ী, ভোলা

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা জমিদার বাড়িগুলোর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য নাম হচ্ছে ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার সাচড়া ইউনিয়নে অবস্থিত ঐতিহাসিক তালুকদার জমিদার বাড়ি। স্থানীয়দের কাছে এই বাড়ি “দেউলা জিন্নাতুল্লা তালুকদার বাড়ি” (Talukder Bari) নামে সুপরিচিত, যা তার প্রাচীন স্থাপত্য, সংস্কৃতি এবং অতীতের রাজকীয় আভিজাত্যের প্রতিফলন।

এই জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জমিদার বোরহানউদ্দিন, যিনি প্রায় ১৮০ বছর পূর্বে এই বিলাসবহুল বাড়িটি নির্মাণ করেন। সেই সময় তিনি ভোলার অন্তর্গত ২৭টি মৌজার একচ্ছত্র অধিকারী ছিলেন। জমিদারি প্রথার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বোরহানউদ্দিন তার বিশাল সম্পদ ও ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে এই বাড়ি তৈরি করেন, যা এখনও স্থাপত্যশৈলীর উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটির আদি সৌন্দর্য অনেকটাই ম্লান হয়ে গেলেও তার ঐতিহাসিক মূল্য ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অপরিবর্তিত রয়েছে।

জমিদার বাড়ির স্থাপত্য ও পরিবেশ

তালুকদার বাড়িটি ঘিরে থাকা প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং এর আশেপাশের স্থাপত্যশৈলী একে অন্যান্য জমিদার বাড়ির তুলনায় অনন্য করে তুলেছে। বাড়িটির চারপাশে রয়েছে অসংখ্য গাছ-গাছালি, যা এক ধরণের প্রাকৃতিক সুরক্ষা বলয় তৈরি করে। গাছের শীতল ছায়া ও সবুজে ঘেরা এই এলাকা সেই সময়কার জমিদারি আভিজাত্য এবং বিলাসবহুল জীবনযাপনের প্রতীক।

তালুকদার বাড়ির পূর্ব-উত্তর দিকে রয়েছে একটি বিশাল দীঘি। এই দীঘি শুধুমাত্র বাড়ির নান্দনিকতায় নয়, বরং স্থানীয়দের কাছে ধর্মীয় এবং সামাজিক কাজের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেও পরিচিত। দীঘিটির পাশেই একটি প্রাচীন মসজিদ রয়েছে, যা জমিদারি সময়ে নির্মিত হয়েছিল। এই মসজিদটির স্থাপত্য শৈলী জমিদারদের ইসলামি সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ এবং ধার্মিক চেতনার প্রতীক।

তবে জমিদার বাড়ির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ হলো এর হল রুম। এই বিশাল এবং দৃষ্টিনন্দন হল রুমটি জমিদারদের রাজকীয় জমায়েত, গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এবং সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত হতো। হল রুমের শিল্পকলা, দেয়ালের নকশা, এবং অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা এখনও অতীতের ঐশ্বর্যের পরিচয় বহন করে।

জমিদার বংশধরদের বর্তমান বসবাস

বর্তমানে এই ঐতিহাসিক জমিদার বাড়িটি জমিদার বংশের উত্তরসূরিদের বসবাসের স্থান। যদিও সময়ের সাথে সাথে বাড়িটির স্থায়িত্ব এবং সৌন্দর্য অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারপরও জমিদার বংশধররা এই বাড়ির ঐতিহ্য রক্ষা করতে সচেষ্ট। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাড়িটির কিছু অংশ নষ্ট হয়ে গেলেও তার মূল আকর্ষণ এখনো দর্শনার্থীদের মন জয় করে। পর্যটকরা এখানে এলে সেই সময়কার জমিদারির গৌরবময় দিনগুলোর কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারেন।

কিভাবে তালুকদার বাড়ি যাবেন

ভোলার তালুকদার জমিদার বাড়ি ভ্রমণের জন্য আপনাকে প্রথমে ঢাকা থেকে ভোলা জেলায় যেতে হবে। ঢাকা থেকে ভোলায় যাওয়ার সবচেয়ে সুবিধাজনক পথ হলো নৌপথ। ঢাকা সদরঘাট থেকে বেশকিছু লঞ্চ ভোলা নৌরুটে চলাচল করে। সাধারণত, ঢাকা থেকে ভোলায় লঞ্চের যাত্রা বেশ আরামদায়ক এবং সাশ্রয়ী। লঞ্চ ভ্রমণকালে আপনি মেঘনা নদীর অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। ভোলা পৌঁছে সেখান থেকে বাস বা সিএনজিতে বোরহানউদ্দিন উপজেলায় যাত্রা করতে হবে। বোরহানউদ্দিন পৌঁছার পর স্থানীয় পরিবহণ ব্যবহার করে সাচড়া ইউনিয়নের তালুকদার জমিদার বাড়িতে পৌঁছানো সম্ভব।

থাকার ব্যবস্থা

ভোলায় ভ্রমণ করতে এলে পর্যটকদের জন্য রয়েছে বেশকিছু মানসম্মত আবাসিক হোটেল। ভোলা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন পর্যায়ের হোটেল পাওয়া যায়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দ্যা পাপিলন হোটেল, হোটেল বে আইল্যান্ড, ক্রিস্টাল ইন, হোটেল জেড ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল আহসান, হোটেল জাহান, হোটেল গোল্ডেন প্লাজা, মাহবুবা ইন্টারন্যাশনাল, রয়েল প্যালেস ইত্যাদি। এসব হোটেলগুলোতে আপনি আপনার বাজেট অনুযায়ী থাকার উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে পারবেন। বেশিরভাগ হোটেলেই আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, যেমন এয়ার কন্ডিশনিং, ফ্রি ওয়াই-ফাই, রুম সার্ভিস ইত্যাদি সুবিধা পাওয়া যায়।

খাবারের স্থান

ভোলা জেলা ভ্রমণের সময় খাওয়ার জন্যও রয়েছে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। ঢাকা থেকে তালুকদার বাড়ি যেতে হলে পথিমধ্যে বেশকিছু ভালো রেস্তোরাঁ পাওয়া যাবে। এর মধ্যে রয়েছে বিএফসি, জুয়েল ফুড স্টোর, চায়না গার্ডেন চাইনিজ ও বিরিয়ানি হাউজ, ফুড সমাহার ইত্যাদি। এসব রেস্তোরাঁয় মানসম্মত চাইনিজ, ভারতীয় এবং দেশীয় খাবার পাওয়া যায়। এছাড়া ভোলা সদর এলাকাতেও বেশকিছু ভালো মানের রেস্তোরাঁ রয়েছে, যেখানে দেশীয় মজাদার খাবার পাওয়া যায়। যদি সময় থাকে, তবে ঘুইঙ্গার হাটের মিষ্টি এবং ঘোষের দই খেতে ভুলবেন না। ভোলার এই বিখ্যাত মিষ্টি এবং দই ভোজনরসিকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ।

ভোলার অন্যান্য দর্শনীয় স্থান

ভোলা জেলা কেবল জমিদার বাড়ি কিংবা ইতিহাসের জন্যই বিখ্যাত নয়, বরং এখানে ভ্রমণের জন্য আরও অনেক আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে। ভোলার বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল জাদুঘর একটি উল্লেখযোগ্য স্থান, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ধারণ করে। স্বাধীনতা জাদুঘরও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন।

তাছাড়া ভোলার নিজাম হাসিনা মসজিদ তার স্থাপত্যশৈলীর জন্য বিখ্যাত। যারা আধুনিক স্থাপত্যের প্রতি আগ্রহী, তাদের জন্য জ্যাকব টাওয়ার একটি চমৎকার গন্তব্য। এই টাওয়ারটি ভোলার অন্যতম উল্লেখযোগ্য পর্যটন আকর্ষণ।

প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য চর কুকরি মুকরি এবং মনপুরা দ্বীপ অপরিহার্য ভ্রমণ স্থান। মনপুরা দ্বীপ তার সবুজ মাঠ, নীল জল এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত। অন্যদিকে চর কুকরি মুকরি একটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী এবং পাখির দেখা মেলে।

উপসংহার

ভোলার ঐতিহাসিক তালুকদার জমিদার বাড়ি শুধু একটি স্থাপত্য নিদর্শন নয়, এটি সেই সময়কার জমিদারি প্রথার এক জীবন্ত স্মৃতি। তার গৌরবময় অতীত এবং বর্তমানের বিবর্তন একে সময়ের সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। এই জমিদার বাড়িটি যেমন ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান, তেমনি পর্যটকদের জন্যও এটি একটি মনোমুগ্ধকর ভ্রমণ স্থান। ভোলার জমিদার বাড়ির পাশাপাশি এর আশেপাশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করে পর্যটকরা এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top