সুরা মসজিদ

সুরা মসজিদ

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলির মধ্যে সুরা মসজিদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই মসজিদটি শুধু ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতীক নয়, বরং এর স্থাপত্যশৈলী এবং নির্মাণকৌশল বাংলাদেশের মুসলিম স্থাপত্যের অন্যতম সেরা নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রাচীন স্থাপত্যের জৌলুস এবং মুসলিম শাসনামলের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, এই মসজিদে মুগ্ধ হন হাজারো পর্যটক। সুরা মসজিদ দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলায় অবস্থিত, এবং এটি বহু শতাব্দী পুরনো ইতিহাস ও স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়।

সুরা মসজিদের অবস্থান

সুরা মসজিদটি দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলায়, ঘোড়াঘাট উপজেলা কেন্দ্র থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। মসজিদটি একটি বিশাল পাড়ওয়ালা দীঘির দক্ষিণ পাশে নির্মিত হয়েছে। পাকা রাস্তা ধরে প্রায় ৩৫০-৪০০ গজ উত্তরে গেলে এই দীঘির পাড় ঘেঁষেই দেখা মিলবে সুরা মসজিদের। মসজিদটিকে ঘিরে এলাকাটি এক অনন্য শৈল্পিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ধারণ করে আছে, যা ধর্মীয় ভাবাবেগের পাশাপাশি দর্শকদের জন্যও আকর্ষণীয়।

মসজিদের স্থাপত্যশৈলী ঐতিহ্যের সাক্ষ্যবাহী নির্মাণ

নির্মাণকৌশল ও সময়কাল

প্রায় সাড়ে ৫০০ বছরের পুরনো এই মসজিদটি বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। সুরা মসজিদের নির্মাণকাল নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। অনেকে মনে করেন, এটি ১৬ শতকে সুলতানি আমলে হোসেন শাহীর শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল। আবার অনেক স্থানীয় বাসিন্দা বিশ্বাস করেন, এই মসজিদটি অদৃশ্য শক্তি বা জিন দ্বারা এক রাতে নির্মিত হয়। এর কারণেই এর নামের সঙ্গে ‘সুরা’ বা ‘অপদেবতা’ শব্দটি যুক্ত হয়েছে। স্থানীয় কিংবদন্তী অনুসারে, মসজিদটি “গায়েবি” বা ‘আসমানি’ মসজিদ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

শাহ সুজার মসজিদ

মসজিদটির আরেকটি নাম “শাহ সুজা মসজিদ”, যা মুঘল আমলের বাংলার সুবেদার শাহ্ সুজার নামে পরিচিত। অনেকেই মনে করেন, শাহ সুজা এই মসজিদ নির্মাণ করিয়েছিলেন এবং সেই থেকে এটি এই নামে পরিচিত। এই মতানুসারে, মসজিদটি মুঘল আমলের স্থাপত্যশৈলীর আদলে নির্মিত হয়েছে।

মসজিদের গঠন ও স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য

সুরা মসজিদ প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত: মূল নামাজ কক্ষ ও বারান্দা। মসজিদের মোট আয়তন প্রায় ৭.৮৪ মিটার x ৭.৮৪ মিটার, এবং বারান্দার আকার ৪.৪৮ মিটার লম্বা ও ২.১২ মিটার প্রশস্ত। মসজিদটি ছোট আকৃতির ইট ও চুন-সুরকির মিশ্রণে নির্মিত হয়েছে। দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় ১.৮০ মিটার, যা স্থাপত্যের প্রাচীন ধাঁচের এক অসাধারণ উদাহরণ।

গম্বুজের বৈশিষ্ট্য

মসজিদের মূল নামাজ কক্ষটি অর্ধগোলাকার একটি গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। বারান্দায় রয়েছে অনুরূপ তিনটি গম্বুজ, যা সামঞ্জস্যপূর্ণ আকারে সাজানো হয়েছে। প্রতিটি গম্বুজ মসজিদের স্থাপত্যের একটি বিশেষ দিক প্রকাশ করে। গম্বুজের এই নকশা সুলতানি ও মুঘল স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণে তৈরি, যা সেই সময়কার শাসকদের সংস্কৃতিগত ও ধর্মীয় প্রভাব প্রকাশ করে।

প্রবেশপথ ও মিহরাব

মসজিদটির প্রবেশপথের দিকেও বিশেষ স্থাপত্য শৈলী লক্ষ্য করা যায়। মসজিদের পূর্ব দিকে তিনটি খিলানকৃত প্রবেশপথ রয়েছে এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে আরও দুটি প্রবেশপথ। বারান্দার উভয় পাশে একটি করে ছোট প্রবেশপথ রয়েছে, যা ভেতরে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়। মসজিদের কিবলা দেয়ালে সুন্দরভাবে অলংকৃত তিনটি অবতল মিহরাব রয়েছে। এই মিহরাবগুলো পাথরের তৈরি এবং বিশেষ শিল্পকৌশলে খোদাই করা, যা মসজিদের অভ্যন্তরীণ শৈল্পিক সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তোলে।

সুরা মসজিদের সঙ্গে যুক্ত লোককথা ও বিশ্বাস

সুরা মসজিদকে ঘিরে স্থানীয়দের মধ্যে নানা ধরনের লোককথা প্রচলিত রয়েছে। কিছু লোকের মতে, মসজিদটি অপদেবতা বা জিন দ্বারা এক রাতে নির্মিত হয়েছিল। আবার কেউ কেউ মনে করেন, মসজিদটি অলৌকিকভাবে আবির্ভূত হয়েছে এবং এটি ‘গায়েবি মসজিদ’ হিসেবে পরিচিত। এই লোককথাগুলি মসজিদটির ধর্মীয় গুরুত্ব এবং ঐতিহাসিক মূল্যকে আরও গভীরতর করে তোলে। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা এবং ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে, মসজিদটির নির্মাণকাল ১৬ শতকে হোসেন শাহীর শাসনামলের সময়কালের মধ্যে পড়ে বলে ধরা হয়।

কিভাবে সুরা মসজিদে যাবেন

সড়কপথে যাতায়াত

ঢাকা থেকে সুরা মসজিদে যাতায়াতের জন্য সড়কপথ সবচেয়ে সহজ এবং জনপ্রিয়। ঢাকা থেকে বাসে করে দিনাজপুর পৌঁছানো সম্ভব। ঢাকার গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে দিনাজপুরগামী বাসগুলো ছেড়ে যায়। উল্লেখযোগ্য বাস সার্ভিসগুলোর মধ্যে রয়েছে নাবিল পরিবহন, এস আর ট্রাভেলস, এস এ পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, কেয়া পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন ইত্যাদি। নন-এসি ও এসি বাসের ভাড়া ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে পড়ে।

রেলপথে যাতায়াত

রেলপথে যাতায়াতও একটি উত্তম বিকল্প। ঢাকার কমলাপুর এবং বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে একতা এক্সপ্রেস, দ্রুতযান এক্সপ্রেস এবং পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেন দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। রেল ভাড়া শ্রেণিভেদে ৫৫০ টাকা থেকে ১,৮৮৬ টাকার মধ্যে পরিবর্তিত হয়। ট্রেনে গাইবান্ধা স্টেশনে নামার পর বাস অথবা সিএনজি অটোরিকশায় করে পলাশবাড়ী যেতে হবে, সেখান থেকে সুরা মসজিদ যাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়।

স্থানীয় যাতায়াত

গোবিন্দগঞ্জ বা পলাশবাড়ী থেকে সুরা মসজিদে পৌঁছানো বেশ সহজ। গোবিন্দগঞ্জ থেকে অটো রিকশা বা ভ্যানের মাধ্যমে ঘোড়াঘাটের সুরা মসজিদে পৌঁছানো সম্ভব। এছাড়া পলাশবাড়ী থেকেও একই ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। ঘোড়াঘাট ও পলাশবাড়ী একে অপরের খুব কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় এই দুটি জায়গা থেকেই মসজিদে যাতায়াত সহজ হয়।

কোথায় থাকবেন

সুরা মসজিদের আশেপাশে থাকার জন্য তেমন কোনো সুব্যবস্থা নেই। তাই মসজিদটি ভ্রমণ শেষে রাত্রীযাপনের জন্য দিনাজপুর শহরে ফিরে আসতে হয়। দিনাজপুরে বেশ কিছু মানসম্পন্ন হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে, যেখানে ভ্রমণকারীরা স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারেন। এছাড়াও, গাইবান্ধা বা গোবিন্দগঞ্জের আশেপাশেও কিছু মাঝারি মানের থাকার জায়গা পাওয়া যায়।

দিনাজপুরের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান

দিনাজপুর শুধু সুরা মসজিদেই সীমাবদ্ধ নয়, এখানে আরও অনেক ঐতিহাসিক এবং প্রাকৃতিক স্থান রয়েছে যা পর্যটকদের মুগ্ধ করে। দিনাজপুরের উল্লেখযোগ্য কিছু দর্শনীয় স্থান হল:

  1. দিনাজপুর রাজবাড়ী: প্রাচীন এই রাজবাড়ীটি দিনাজপুরের অন্যতম আকর্ষণ। এর প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব একে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য করে তোলে।
  2. হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়: দেশের অন্যতম প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা শুধুমাত্র শিক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যও পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়।
  3. নয়াবাদ মসজিদ: দিনাজপুরের আরেকটি ঐতিহাসিক মসজিদ, যা স্থাপত্যশৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ। এটি সুরা মসজিদের মতোই পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
  4. স্বপ্নপুরী পিকনিক স্পট: পরিবার নিয়ে অবকাশ যাপনের জন্য স্বপ্নপুরী একটি মনোরম জায়গা। এখানে বিভিন্ন বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে যা পর্যটকদের কাছে দারুণ আকর্ষণীয়।
  5. রামসাগর দীঘি: বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দীঘি হিসেবে পরিচিত রামসাগর দীঘি, যা একটি ঐতিহাসিক জলাশয় এবং পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।
  6. কান্তজীর মন্দির: কান্তজীর মন্দির, যা ‘কান্তনগর মন্দির’ নামেও পরিচিত, বাংলাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং স্থাপত্যগতভাবে সমৃদ্ধ হিন্দু মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম। এর দেয়ালে উৎকীর্ণ কারুকাজ অত্যন্ত প্রশংসনীয়।

উপসংহার

সুরা মসজিদ দিনাজপুরের এক অনন্য স্থাপত্যকীর্তি এবং ইসলামী ঐতিহ্যের ধারক। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই মসজিদটি তার গৌরবময় ইতিহাস ও রহস্যময় লোককাহিনীগুলির সঙ্গে আজও দাঁড়িয়ে আছে। যারা ইসলামী স্থাপত্য এবং প্রাচীন ঐতিহ্যকে কাছ থেকে দেখতে চান, তাদের জন্য সুরা মসজিদ একটি আদর্শ গন্তব্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top