নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলার পাটুলি ইউনিয়নে অবস্থিত শাহ ইরানী (রঃ) মাজার শরীফ বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক নিদর্শন। এই মাজারটি শুধুমাত্র ধর্মীয় গন্তব্য নয়, বরং এর স্থাপত্যশৈলী এবং এর সাথে জড়িত ইতিহাসের কারণে পর্যটকদেরও আকর্ষণ করে।
শাহ ইরানী (রঃ): এক মহান আউলিয়ার ইতিহাস
শাহ ইরানী (রঃ) সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য ইতিহাসের পাতায় খুব কমই লিপিবদ্ধ আছে। তবুও ইতিহাসবিদদের মতে, ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে পারস্য (ইরান), ইয়েমেন, ইরাক, মিশর এবং তুরস্কের বিখ্যাত আউলিয়াগণ উপমহাদেশে আগমন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই হযরত শাহজালাল (রঃ)-এর সঙ্গী হিসেবে এসেছিলেন। এমনই একজন মহান আউলিয়া হলেন শাহ ইরানী (রঃ)। ধারণা করা হয়, তিনি ইরানের রাজ পরিবারের সদস্য ছিলেন এবং ধর্ম প্রচারের জন্য ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল আনুমানিক ৪০ বছর।
তাঁর প্রকৃত নাম অজানা থাকলেও, ইরানের অধিবাসী হওয়ার কারণে “শাহ ইরানী” নামে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। বিভিন্ন ইতিহাসবিদ এবং গবেষকরা ধারণা করেন যে, তাঁর নামের সাথে “শাহ” উপাধি মূলত ইরানীয় সাম্রাজ্যের রাজকীয় উপাধি থেকে এসেছে, যা তাঁকে একজন সম্মানিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রকাশ করে।
মাজারের স্থাপত্যশৈলী এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব
প্রায় ৬৩ একর জায়গা নিয়ে বিস্তৃত শাহ ইরানী (রঃ) মাজার শরীফের স্থাপত্যশৈলী সুলতানি আমলের অন্যান্য স্থাপনার সাথে তুলনীয়। বিশেষ করে, মাজারের সামনের প্রবেশদ্বারে থাকা পাথর ও খিলান প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন বহন করে, যা প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত।
মাজারের পূর্ব পাশে অবস্থিত সুবিশাল দিঘী, যা মহারানীর দিঘী নামে পরিচিত, এটিকে বৃহত্তর ঢাকার বৃহত্তম দিঘী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই দিঘীর নামকরণের ইতিহাস এবং মাজারের সাথে এর সম্পর্ক স্থানীয়দের কাছে একটি কিংবদন্তির মতো ছড়িয়ে আছে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করেন, এই মাজার শরীফটি ৫ম বা ৬ষ্ঠ শতকের পূর্বেকার একটি স্থাপত্য নিদর্শন, যা ইতিহাসের বিবর্তনকে প্রামাণ্য করে।
শাহ ইরানী (রঃ)-এর প্রভাব এবং ইসলাম প্রচার
শাহ ইরানী (রঃ) শুধু একজন আধ্যাত্মিক নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন ইসলাম প্রচারের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তাঁর আগমনকালে বাংলার এই অঞ্চলটি বিভিন্ন ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক প্রবাহের সংমিশ্রণে ছিল। সুলতানি আমলের সময় থেকেই বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচারের কাজ শুরু হয়, এবং শাহ ইরানী (রঃ) সেই প্রচারের অন্যতম অগ্রদূত ছিলেন।
তাঁর অসামান্য প্রভাব এবং সাদাকাহময় জীবনের ফলে, স্থানীয় মানুষ তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতে শুরু করে। তিনি যে সহজ-সরল জীবনযাপন এবং মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বানের জন্য নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন, সেটি আজও মানুষের মধ্যে প্রভাবিত করে। তাই আজও শাহ ইরানী (রঃ)-এর মাজারে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসেন প্রার্থনা করতে এবং তাঁর কাছ থেকে বরকত লাভের আশায়।
মাজারে ভ্রমণ যাতায়াত এবং দর্শনীয় স্থানসমূহ
কিভাবে যাবেন
শাহ ইরানী (রঃ) মাজার শরীফে যাতায়াত খুব সহজ। যদি আপনি রাজধানী ঢাকা থেকে মাজার দর্শনে আসতে চান, তবে বিভিন্ন উপায়ে আসতে পারেন। ঢাকা থেকে সিলেট, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কিংবা নরসিংদীগামী বাসগুলোতে চড়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মরজাল বা বারৈচা বাসস্ট্যান্ডে নামুন। সেখান থেকে স্থানীয় যানবাহনে যেমন সিএনজি, অটোরিকশা বা ভ্যানগাড়িতে পোড়াদিয়া বাজার পর্যন্ত আসতে পারবেন।
পোড়াদিয়া বাজার থেকে রিকশাযোগে খুব সহজেই শাহ ইরানী (রঃ) মাজারে পৌঁছাতে পারবেন। মরজাল এবং বারৈচা থেকে সরাসরি মাজার শরীফে পৌঁছানোর সিএনজিও সহজেই পাওয়া যায়। পুরো যাত্রাটি অত্যন্ত মনোরম এবং পথের দৃশ্য উপভোগ্য।
থাকার ব্যবস্থা
যদি আপনি নরসিংদীতে থেকে যেতে চান, তবে বেশ কয়েকটি থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। ঢাকা থেকে আসার পর নরসিংদীতে সারাদিন ঘোরাফেরা করে সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরতে পারবেন। তবে, যদি রাত্রীযাপনের প্রয়োজন হয়, নরসিংদী জেলায় বেশ কয়েকটি থাকার ব্যবস্থা পাওয়া যায়। এর মধ্যে ইব্রাহীম কটেজ, সার্কিট হাউস, এলজিইডির রেস্ট হাউস এবং জেলা পরিষদের ডাকবাংলো উল্লেখযোগ্য। এসব জায়গায় আপনি নিরাপদে এবং আরামে রাত্রি যাপন করতে পারবেন।
খাবারের ব্যবস্থা
নরসিংদীতে প্রচুর খাবারের হোটেল রয়েছে যেখানে স্থানীয় এবং দেশীয় খাবারের বিস্তৃত সমারোহ পাবেন। ফাল্গুনি হোটেল, বাবুর্চি আলমগীর হোটেল, বন্ধু হোটেল, খোকন হোটেল ইত্যাদি হোটেলগুলোতে সুস্বাদু খাবার পাওয়া যায়।
নরসিংদীর বিশেষ খাবারের মধ্যে অন্যতম হলো রসগোল্লা, লালমোহন, খিরমোহন এবং শাহী জিলাপি। এগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং স্থানীয়দের পাশাপাশি পর্যটকদের কাছেও বেশ সমাদৃত। এছাড়াও, ভেলানগরের সুস্বাদু মালাই চা একবার হলেও চেখে দেখার মতো।
শাহ ইরানী (রঃ) মাজার শরীফ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
শাহ ইরানী (রঃ)-এর মাজার শরীফ শুধুমাত্র একটি আধ্যাত্মিক কেন্দ্র নয়, এটি বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত। এই মাজারে প্রতি বছর হাজার হাজার ভক্তের আগমন ঘটে, যারা এখানে এসে নিজেদের ধর্মীয় অনুভূতির প্রকাশ ঘটান এবং শাহ ইরানী (রঃ)-এর থেকে বরকত লাভের আশায় প্রার্থনা করেন।
ইসলামের ইতিহাসে আউলিয়াগণের অবদান অমূল্য। তাঁরা ধর্ম প্রচারের মাধ্যমে সমাজের নৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। শাহ ইরানী (রঃ) তাঁদেরই একজন যিনি এই অঞ্চলে ইসলামের আলো ছড়িয়েছেন। তাঁর অবদান শুধু ধর্মীয় দিক থেকে নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও ছিল ব্যাপক।
স্থানীয় সংস্কৃতি ও কিংবদন্তি
শাহ ইরানী (রঃ)-এর সাথে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় কিংবদন্তি এবং লোককথা এই মাজারকে ঘিরে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস মতে, শাহ ইরানী (রঃ)-এর আধ্যাত্মিক ক্ষমতা এবং তাঁর আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস তাঁকে এক বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।
মহারানীর দিঘী মাজারের পাশের ঐতিহাসিক দিঘী
মাজারের পূর্ব পাশে অবস্থিত বিশাল দিঘীটি মহারানীর দিঘী নামে পরিচিত। স্থানীয় কিংবদন্তি অনুসারে, এই দিঘীটি তৈরি করা হয়েছিল একটি বিশেষ কারণকে কেন্দ্র করে। এটি বৃহত্তর ঢাকার সবচেয়ে বড় দিঘী হিসেবে পরিচিত এবং মাজারের সাথে এর সম্পর্ক বেশ গভীর।
এই দিঘীর ইতিহাস স্থানীয় লোককথার সাথে গভীরভাবে জড়িত। বিশ্বাস করা হয় যে, এই দিঘীটির পানিতে অজানা এক ধরনের বরকত রয়েছে, যা বহু ভক্তদের আধ্যাত্মিকভাবে প্রশান্ত করে।