জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর

১৯৬৫ সালের ২৬ এপ্রিল, তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ঢাকায় জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর (National Museum of Science and Technology) প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল সেই সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ, যা বাংলাদেশের বিজ্ঞানের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ এবং জ্ঞানের প্রসার বৃদ্ধিতে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে। প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস পর, সেপ্টেম্বর মাসে, জাদুঘরটি ঢাকা গণগ্রন্থাগার ভবনে স্থানান্তর করা হয় এবং ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসে এটি চামেলীবাগে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে, এর অবস্থান পুনরায় পরিবর্তিত হয়ে ১৯৭১ সালের মে মাসে ধানমন্ডির ১ নম্বর সড়কে স্থানান্তরিত হয়।

১৯৭২ সালে, বাংলাদেশ সরকার এই প্রতিষ্ঠানটিকে জাতীয় জাদুঘরের মর্যাদা প্রদান করে, এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এটি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ১৯৮৭ সাল থেকে, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর তার নিজস্ব ভবন থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে এটি রাজধানী ঢাকার আগারগাঁওয়ে বিএনপি বাজার এলাকায় অবস্থিত।

জাদুঘরের বিবর্তন এবং স্থাপত্য

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরকে ঘিরে রয়েছে ৪ তলা বিশিষ্ট একটি প্রধান ভবন। এই ভবনের ভেতরে রয়েছে আকর্ষণীয় বিভিন্ন গ্যালারি এবং শিক্ষণীয় প্রদর্শনী। প্রথম এবং দ্বিতীয় তলায় প্রধানত প্রদর্শনী গ্যালারি রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং বিজ্ঞানীদের অবদান দেখানো হয়েছে। তৃতীয় তলায় রয়েছে অফিস, যেখানে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ভবনের চতুর্থ তলায় বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি অবস্থিত, যা দেশের বিজ্ঞানীদের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য স্থান হিসেবে কাজ করছে।

এই জাদুঘরটি সাতটি গ্যালারিতে বিভক্ত, প্রতিটি গ্যালারি ভিন্ন ভিন্ন বৈজ্ঞানিক দিক নিয়ে সাজানো হয়েছে। পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান থেকে শুরু করে পরমাণু বিজ্ঞান পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ এখানে আছে। বিজ্ঞান শিক্ষার পাশাপাশি জাদুঘরে বিজ্ঞান ভিত্তিক বিনোদনেরও যথেষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে, যা দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে এবং শিক্ষার পাশাপাশি তাদের মুগ্ধ করে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের গ্যালারির বৈশিষ্ট্যসমূহ

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মূল আকর্ষণ তার গ্যালারিগুলো। প্রতিটি গ্যালারি এক একটি নির্দিষ্ট বিজ্ঞান শাখার উপর নির্ভর করে সাজানো হয়েছে। এখানে কিছু উল্লেখযোগ্য গ্যালারির বিবরণ দেওয়া হলো:

১. পদার্থবিজ্ঞান গ্যালারি

পদার্থবিজ্ঞান গ্যালারিতে রয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জাদু। এখানে আমরা কিভাবে পদার্থবিজ্ঞানের মূলনীতি এবং তত্ত্ব বাস্তবে কার্যকর হয় তা দেখতে পাই। এখানে রয়েছে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক উপকরণ, যা পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের এবং বিজ্ঞান-প্রেমীদের জন্য দারুণ উৎসাহব্যঞ্জক।

২. জীববিজ্ঞান গ্যালারি

জীববিজ্ঞান গ্যালারিতে জীবনের বিভিন্ন ধাপ, জীববিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো এবং বিজ্ঞানের প্রয়োগ দেখা যায়। শিক্ষার্থীরা এই গ্যালারি থেকে জীববিজ্ঞানের মৌলিক ধারণা সম্পর্কে আরো ভালো ধারণা পেতে পারে।

৩. পরমাণু কর্নার

পরমাণু বিজ্ঞান এক যুগান্তকারী শাখা, যা আমাদের আধুনিক জীবনে বিশাল প্রভাব ফেলেছে। এই গ্যালারিতে রয়েছে পরমাণু শক্তি, এর ব্যবহার এবং প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। দর্শনার্থীরা এখান থেকে পরমাণু বিজ্ঞানের নানা দিক সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারেন।

৪. শিল্পপ্রযুক্তি গ্যালারি

শিল্পপ্রযুক্তি গ্যালারি বেশ আকর্ষণীয়। এখানে বিভিন্ন যুগের শিল্পের যন্ত্রপাতি, বিশেষ করে প্রাচীন থেকে আধুনিক শিল্পের প্রগতির ছবি তুলে ধরা হয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, এখানে বাংলাদেশের প্রথম আইবিএম কম্পিউটার রাখা আছে, যা প্রযুক্তিগত ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।

অন্যান্য আকর্ষণীয় বিষয়সমূহ

প্রদর্শনী ছাড়াও, এখানে রয়েছে একটি গ্রন্থাগার, যেখানে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বই ও জার্নাল পাওয়া যায়। শিক্ষার্থী এবং গবেষকদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এছাড়াও একটি কর্মশালা এবং মিলনায়তন রয়েছে, যেখানে বিজ্ঞান বিষয়ক কর্মশালা, আলোচনা সভা এবং অন্যান্য শিক্ষামূলক কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়।

জাদুঘরের প্রবেশপথে একটি ডাইনোসরের বিশাল মূর্তি এবং ভবনের প্রাঙ্গণে একটি ছোট যুদ্ধ বিমান দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এসব প্রদর্শনী দর্শকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের দর্শনার্থী সংখ্যা এবং জনপ্রিয়তা

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে প্রতি বছর প্রায় দেড় লাখ দর্শক আসে। ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে বিজ্ঞানপ্রেমী জনগণ, সবাই এখানে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানার জন্য আগ্রহী। বিশেষত শিক্ষার্থীদের জন্য এটি একটি আদর্শ শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে, যেখানে বিজ্ঞানকে প্রয়োগিক দৃষ্টিতে দেখা এবং বোঝার অসামান্য সুযোগ রয়েছে।

বিজ্ঞান-ভিত্তিক শিক্ষার প্রসারে এই জাদুঘরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এর প্রদর্শনী এবং উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ড ক্রমশ জাদুঘরটিকে একটি প্রিয় গন্তব্যস্থলে পরিণত করছে। দর্শনার্থীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রেও এর অবদান ব্যাপকভাবে প্রসারিত হচ্ছে।

জাদুঘরে প্রবেশমূল্য এবং সময়সূচী

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের প্রবেশমূল্য খুবই সাশ্রয়ী। প্রতিটি দর্শনার্থীর জন্য প্রবেশমূল্য মাত্র ২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষভাবে সুবিধাজনক। এছাড়াও, এখানে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রদর্শনী এবং মুভি দেখার জন্য ভিন্ন ভিন্ন টিকিট মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

  • 4D/9D মুভি দেখার জন্য জনপ্রতি টিকেট মূল্য: ৪০ টাকা
  • টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ দেখার জন্য টিকিট মূল্য: ১০ টাকা
  • VR মুভি দেখার জন্য টিকিট মূল্য: ২০ টাকা

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর সপ্তাহের পাঁচ দিন খোলা থাকে। বৃহস্পতিবার এবং সরকার ঘোষিত ছুটির দিন বাদে, রবিবার থেকে বুধবার জাদুঘরটি সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৫টা পর্যন্ত দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।

গ্রীষ্মকালীন সময়সূচী (এপ্রিল-অক্টোবর):

  • শুক্রবার: বেলা ৩:৩০ থেকে ৭:০০ পর্যন্ত
  • শনিবার: বেলা ১১:০০ থেকে ৬:০০ পর্যন্ত

শীতকালীন সময়সূচী (নভেম্বর-মার্চ):

  • শুক্রবার: বেলা ৩:০০ থেকে ৬:০০ পর্যন্ত
  • শনিবার: বেলা ১০:০০ থেকে ৬:০০ পর্যন্ত

জাদুঘরের টিকেট সংগ্রহের পদ্ধতি

জাদুঘরের টিকেট সংগ্রহ করা অত্যন্ত সহজ। অনলাইনে টিকেট কাটার ব্যবস্থা রয়েছে, যা দর্শনার্থীদের জন্য আরো সুবিধাজনক। অনলাইনে টিকেট কিনতে হলে দর্শকরা এই লিংকটি ব্যবহার করতে পারেন: https://eticket.most.gov.bd/services/nmst/e-ticketing/home

অফলাইনে জাদুঘরের প্রবেশপথেও টিকেট কেনার ব্যবস্থা আছে, যা দর্শকদের জন্য একটি সহজ এবং দ্রুত সমাধান প্রদান করে।

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে যাওয়ার উপায়

রাজধানী ঢাকার যেকোনো প্রান্ত থেকে সিএনজি, ট্যাক্সি বা বাসে করে সহজেই আগারগাঁওয়ে অবস্থিত জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে পৌঁছানো যায়। মেট্রোরেল ব্যবহারকারীরা আগারগাঁও স্টেশনে নেমে রিকশা বা পায়ে হেঁটে জাদুঘরে যেতে পারেন।

আশেপাশে দর্শনীয় স্থানসমূহ

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের আশেপাশে আরও বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। হাতে সময় থাকলে, দর্শনার্থীরা সেগুলোও ঘুরে দেখতে পারেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর
  • বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার
  • মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
  • বাংলাদেশ বিমান বাহিনী জাদুঘর
  • চন্দ্রিমা উদ্যান

এসব স্থানে ঘুরে বেড়ানো দর্শনার্থীদের জন্য আরো জ্ঞানবৃদ্ধি এবং বিনোদনের সুযোগ তৈরি করে।

উপসংহার

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষা এবং প্রযুক্তির প্রচারে একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান। এর প্রদর্শনী এবং কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্ব বহন করে। জাদুঘরের ভেতরের বৈজ্ঞানিক প্রদর্শনী থেকে শুরু করে শিক্ষণীয় গ্যালারি, সমস্ত কিছুই শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান সম্পর্কে আরও জানার ও বুঝার সুযোগ প্রদান করে। বর্তমান সময়ের প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান।

এই জাদুঘর শুধু একটি প্রদর্শনী কেন্দ্র নয়, বরং এটি বাংলাদেশের বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি চর্চার ইতিহাস ও ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়ার একটি প্রেরণাস্থল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top