ডিসি পার্ক চট্টগ্রাম

ডিসি পার্ক চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অনবদ্য শহর, যেখানে পাহাড়, সমুদ্র, এবং বন্দর একে অপরকে পরিপূরক করে গড়ে তুলেছে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। এরই মধ্যে একটি নতুন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হিসেবে যোগ হয়েছে ডিসি পার্ক, যা ফুলের রঙে এবং সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। এই পার্কটি সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে এবং খুব দ্রুতই এটি একটি বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে দর্শনার্থীদের মন জয় করে নিয়েছে।

ইতিহাস এবং প্রতিষ্ঠা একটি সৃজনশীল উদ্যোগ

২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণের পর আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান সরকারি জমি পুনরুদ্ধার এবং চট্টগ্রামের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেন। ফৌজদারহাট বক্ষব্যাধি হাসপাতালের কাছের একটি বড় সরকারি জমি দখলমুক্ত করার পর, তিনি সেখানে একটি আধুনিক ও বৈচিত্র্যময় ফুলের বাগান তৈরি করার পরিকল্পনা করেন।

এই উদ্যানের নকশা করা হয় দুবাইয়ের বিখ্যাত মিরাকেল গার্ডেন এর আদলে। প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই বাগানটি দ্রুতই চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান আকর্ষণে পরিণত হয়েছে।

প্রতি বছর এখানে অনুষ্ঠিত হয় একটি ব্যতিক্রমী ফুলের মেলা, যা দেখতে দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ আসে। প্রথমবারের মেলায় ১২০ প্রজাতির ফুলের গাছ লাগানো হয় এবং দশ দিনের এ আয়োজনে প্রায় ৫০ হাজার দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। চট্টগ্রামের মানুষ এ আয়োজনকে স্বাগত জানায় এবং এর নান্দনিকতায় মুগ্ধ হয়।

ডিসি পার্কের আকর্ষণ ফুলের বৈচিত্র্য এবং সৌন্দর্য

ডিসি পার্কে প্রবেশ করলেই আপনি ফুলের এক রঙিন সমারোহে হারিয়ে যাবেন। এ বাগানে ১২৭ প্রজাতির এক লক্ষাধিক ফুলের গাছ রয়েছে। বাগানের আকার, প্রজাতির সংখ্যা এবং ফুলের বিশালতা দেখে আপনি হতবাক হতে বাধ্য। এটি এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং বৈচিত্র্যময় ফুলের বাগান হিসেবে পরিচিত।

ফুলের নাম এবং প্রজাতি

ডিসি পার্কে আপনি যেমন দেশীয় প্রজাতির ফুল দেখতে পাবেন, তেমনি এখানে রয়েছে বিদেশি ফুলেরও সুন্দর সমারোহ। কিছু উল্লেখযোগ্য ফুলের নাম হলো:

  • ডালিয়া: বাগানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুলগুলোর মধ্যে একটি। এর সৌন্দর্য এবং রঙিন পাপড়িগুলো দর্শনার্থীদের মন কেড়ে নেয়।
  • চন্দ্রমল্লিকা: শীতকালীন এই ফুলটি তার নিজস্ব সৌন্দর্যে বিখ্যাত।
  • ম্যাগনোলিয়া: বড় আকারের ফুল যা সাদা ও হালকা বেগুনি রঙের হয়ে থাকে।
  • শিউলি ও হাসনাহেনা: এ দুই প্রজাতির ফুলের গন্ধ রাতে চারপাশ ভরে তোলে।
  • অপরাজিতা, চেরি ও জারবেরা: নানান রঙের অপরাজিতা এবং জারবেরা বাগানের শোভা বৃদ্ধি করে।
  • টিউলিপ: টিউলিপ মূলত শীত প্রধান দেশের ফুল হলেও, এখানে এটির ব্যবহারে ভিন্নধর্মী বৈচিত্র্য যুক্ত হয়েছে। টিউলিপ বাগানের আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলে, যা সাধারণত নেদারল্যান্ডসে বেশি দেখা যায়।

এছাড়াও আছে আরও অনেক ফুলের প্রজাতি—উইলো, উইস্টেরিয়া, কনকাম্বরী, হাইব্রিড জবা, চিলিজবা, কৃষ্ণচূড়া, বকুল, পলাশ, শিমুল, করবী, ধানলিলি, নীল পারুল, রেইনলিলি, গন্ধরাজ, কাঠমল্লিকা, বাসন্তী, লিলিয়াম, জিনিয়া, ইনকা মেরী গোল্ড, কামিনী, বেলী, দোলনচাঁপা, মাধবীলতা ইত্যাদি। পার্কের প্রতিটি প্রান্তেই কোনো না কোনো নতুন ফুলের প্রজাতি আপনার নজর কেড়ে নিবে।

ফুলের উৎসব বার্ষিক আয়োজনের বিশেষ আকর্ষণ

ডিসি পার্কের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এখানে প্রতি বছর ফুলের মেলার আয়োজন করা হয়। প্রথমবারে ১২০ প্রজাতির ফুলের গাছ লাগিয়ে আয়োজন করা হয় ১০ দিনের বিশেষ ফুলের উৎসব। এই উৎসবে প্রায় ৫০ হাজার দর্শনার্থীর আগমন ঘটে, যা বাগানের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে।

প্রতিবছর নতুন নতুন ফুলের প্রজাতি যোগ করার মাধ্যমে এ মেলা আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা এবং প্রদর্শনীও আয়োজিত হয় এই মেলায়, যেখানে দর্শনার্থীরা ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি অংশগ্রহণ করতে পারেন।

দর্শনার্থীর সময়সূচী এবং প্রবেশ মূল্য

ডিসি পার্ক সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। দর্শনার্থীরা মাত্র ৩০ টাকা প্রবেশমূল্য দিয়ে এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। তবে বিশেষ উৎসব বা মেলা চলাকালীন সময়ে প্রবেশমূল্য কিছুটা বাড়তে পারে।

সময়সূচী:

  • খোলার সময়: প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা
  • প্রবেশ মূল্য: ৩০ টাকা

ডিসি পার্কে কীভাবে পৌঁছাবেন

ডিসি পার্ক চট্টগ্রাম শহর থেকে সহজেই পৌঁছানো যায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফৌজদারহাট বক্ষব্যাধি হাসপাতাল এর কাছেই পার্কটি অবস্থিত। চট্টগ্রাম শহরের যেকোনো স্থান থেকে বাস, সিএনজি বা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে খুব সহজেই ডিসি পার্কে পৌঁছানো যায়।

যাতায়াতের সুবিধা:

  1. বাস: শহরের প্রধান বাস টার্মিনালগুলো থেকে ফৌজদারহাট যাওয়ার বাস সহজলভ্য।
  2. সিএনজি: সিএনজিতে করে খুব সহজে বন্দর টোল রোডের ডিসি পার্কে যাওয়া যায়।
  3. প্রাইভেট কার: ব্যক্তিগত গাড়িতে গেলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে ফৌজদারহাটের কাছে ডিসি পার্কের প্রবেশদ্বার খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধা হবে না।

খাওয়া-দাওয়ার সুবিধা

ডিসি পার্কের ভিতরে খাবারের দোকান থাকলেও, তুলনামূলকভাবে সেখানে দাম কিছুটা বেশি হতে পারে। তাই অনেক দর্শনার্থী বাইরে থেকেই খাবার নিয়ে আসতে পছন্দ করেন। পার্কের আশেপাশে কয়েকটি স্থানীয় খাবারের দোকানও রয়েছে, যেখানে আপনি স্থানীয় খাবার উপভোগ করতে পারেন।

খাবারের দাম এবং বিকল্প:

  • পার্কের ভিতরে: কিছুটা বেশি দামের খাবার পাওয়া যাবে।
  • পার্কের বাইরে: স্থানীয় রেস্টুরেন্ট এবং খাবারের দোকানে তুলনামূলক সস্তায় খাবার পাওয়া যাবে।

ডিসি পার্কের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ডিসি পার্ককে আরো আকর্ষণীয় এবং পরিবেশ-বান্ধব করার জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। পার্কের ফুলের বাগান আরো সম্প্রসারণের পাশাপাশি এখানে আরও কিছু চিত্তাকর্ষক স্থাপনা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা চলছে।

এছাড়াও, ভবিষ্যতে ফুলের উৎসবকে আন্তর্জাতিক মানের করার পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে বিদেশি পর্যটকরাও এটি উপভোগ করতে পারেন। ফুলের প্রদর্শনীতে নতুন জাতের ফুল যুক্ত করার পাশাপাশি এখানে শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ তৈরির প্রচেষ্টা চলছে, যাতে বাগানের বিশেষত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয়।

ডিসি পার্ক ভ্রমণের কিছু টিপস

ডিসি পার্ক ভ্রমণের জন্য কয়েকটি দরকারী পরামর্শ নিম্নরূপ:

  1. সকালে বা সন্ধ্যায় ভ্রমণ: পার্কের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য সকালের আলো বা সন্ধ্যার সময় সবচেয়ে ভালো।
  2. ক্যামেরা আনুন: বাগানের প্রতিটি কোণই ক্যামেরায় ধারণ করার মতো।
  3. খাবার আনুন: বাইরে থেকে নিজস্ব খাবার নিয়ে আসা ভালো হবে, কারণ ভিতরের খাবারের দাম বেশি।
  4. জুতো: আরামদায়ক জুতো পরুন, কারণ পুরো পার্কটি হেঁটে ঘুরে দেখতে অনেকটা সময় লাগতে পারে।
  5. ছাতা বা টুপি: দিনের বেলায় রোদের সময় ছাতা বা টুপি সঙ্গে রাখলে ভালো হয়।

উপসংহার

ডিসি পার্ক চট্টগ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের নতুন এক সংযোজন। ফুলের রাজ্য হিসেবে পরিচিত এই পার্কটি প্রকৃতিপ্রেমী ও ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এক অসাধারণ গন্তব্য। বৈচিত্র্যময় ফুলের সমারোহ, সৌন্দর্যমণ্ডিত পরিবেশ এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এটি দর্শনার্থীদের মন জয় করে নিয়েছে। যারা প্রকৃতির মাঝে সময় কাটাতে পছন্দ করেন, তাদের জন্য ডিসি পার্ক একটি আদর্শ স্থান।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top