চুনাখোলা মসজিদ

চুনাখোলা মসজিদ

বাগেরহাট জেলার প্রাচীন স্থাপত্যশিল্পে চুনাখোলা মসজিদ একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চুনাখোলা গ্রামে অবস্থিত এই মসজিদটি, তার স্থাপত্যশৈলী ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। প্রায় ১৫ শতকের মধ্যভাগে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয় বলে ধারণা করা হয়। হযরত খান জাহান আলী (রঃ)-এর অধীনে পরিচালিত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে এটি একটি অন্যতম প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে স্থান পেয়েছে।

চুনাখোলা মসজিদের ইতিহাস

চুনাখোলা মসজিদের নির্মাণকাল নিয়ে সুস্পষ্ট তথ্য নেই। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ১৫ শতকে হযরত খান জাহান (রঃ)-এর এক অনুগত কর্মচারী এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। এই মসজিদের নামকরণের পেছনে একটি বিশেষ ইতিহাস রয়েছে। মসজিদটির নিকটবর্তী এলাকায় চুন উৎপাদনের কেন্দ্রস্থল থাকায়, সেটির নাম চুনাখোলা রাখা হয়েছিল। সেখান থেকেই মসজিদটি “চুনাখোলা মসজিদ” নামে পরিচিতি পায়। এই এলাকাটি চুন উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ হযরত খান জাহান (রঃ) তার বিভিন্ন স্থাপনা তৈরিতে চুন ব্যবহার করতেন। পোড়ামাটির অলংকরণ এবং মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের মেলবন্ধন এই মসজিদটিকে আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়েছে।

স্থাপত্যশৈলী ও বৈশিষ্ট্য

চুনাখোলা মসজিদের স্থাপত্যশৈলীতে মধ্যযুগীয় সুলতানী আমলের প্রভাব স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। এটি একটি বর্গাকার মসজিদ, যার বাইরের দিকের দৈর্ঘ্য ৪৯ ফুট এবং অভ্যন্তরীণ দিকের দৈর্ঘ্য ২৫ ফুট। মসজিদের দেয়ালের বেধ ১২.৫০ মিটার এবং চারপাশে চারটি মিনার রয়েছে। এছাড়াও, পশ্চিম দিকের দেয়ালে তিনটি কারুকার্যখচিত মিহরাব দেখা যায়। মসজিদে প্রবেশের জন্য পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে সর্বমোট পাঁচটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। মসজিদটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর পোড়ামাটির অলংকরণ, যা ফুল, লতা-পাতা এবং বিভিন্ন মোটিফ দিয়ে সজ্জিত।

এই মসজিদটি আধুনিককালে সংস্কারের মাধ্যমে পুনর্নির্মাণ করা হয় এবং বর্তমানে এটি একটি ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে এবং ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো চুনাখোলা মসজিদকে “বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” এর অন্তর্ভুক্ত করে।

কীভাবে যাবেন চুনাখোলা মসজিদ

চুনাখোলা মসজিদ পরিদর্শনের জন্য বাগেরহাট পৌঁছানো বেশ সহজ। ঢাকা থেকে সরাসরি বাস বা ট্রেনে খুলনা হয়ে বাগেরহাট পৌঁছানো যায়। গুলিস্তান ও সায়েদাবাদ থেকে বেশ কয়েকটি বাস কোম্পানি, যেমন দোলা পরিবহন, ওয়েলকাম এক্সপ্রেস, ফাল্গুনী পরিবহন, সাকুরা পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, সোহাগ পরিবহন এবং ঈগল পরিবহন বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। এই বাসগুলোর ভাড়া ৬৫০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত হয়। এছাড়া, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে চিত্রা এক্সপ্রেস বা সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে করে খুলনা হয়ে বাগেরহাট যেতে পারেন।

বাগেরহাট শহর থেকে রিকশা বা অটো নিয়ে চুনাখোলা মসজিদে যেতে পারবেন। শহর থেকে মসজিদটির দূরত্ব খুব বেশি নয় এবং ষাট গম্বুজ মসজিদের খুব কাছেই এটি অবস্থিত, ফলে মসজিদে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

চুনাখোলা মসজিদে থাকার ব্যবস্থা

বাগেরহাটে ভ্রমণের জন্য বিভিন্ন আবাসিক হোটেল ও থাকার স্থান রয়েছে, যেখানে পর্যটকরা অবস্থান করতে পারেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হোটেল হলো মমতাজ হোটেল, হোটেল মোহনা, হোটেল আল আমিন, রেসিডেন্সিয়াল হোটেল, হোটেল অভি, হোটেল ফুয়াদ আবাসিক, জারিফ আবাসিক, হোটেল ধানসিঁড়ি, এবং সুন্দরবন রিসোর্ট। এছাড়াও, সরকারি সার্কিট হাউজ ও ডাক বাংলোতে থাকার সুবিধা রয়েছে। এসব হোটেল সাধারণত পর্যটকদের জন্য স্বস্তিদায়ক এবং সুবিধাজনক ব্যবস্থা করে থাকে।

বাগেরহাটের বিখ্যাত খাবার

বাগেরহাট ভ্রমণের সময় স্থানীয় কিছু খাবারের স্বাদ গ্রহণ অবশ্যই উচিত। এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছে চুইঝাল দিয়ে গরুর মাংস, যা বাগেরহাটের নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতির একটি অন্যতম অংশ। এছাড়া, অনিকের রসগোল্লা, সেমাই পিঠা এবং নারিকেল চিংড়ির বিশেষ স্বাদ আপনাকে মুগ্ধ করবে। স্থানীয় খাবারের জন্য আপনি বিবি হোটেল, পর্যটন রেস্তোরাঁ, বিসমিল্লাহ হোটেল, ব্ল্যাক চেরী, রাধুনি হোটেল এবং ধানসিঁড়ি হোটেলে যেতে পারেন।

বাগেরহাটের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান

বাগেরহাট একটি ঐতিহাসিক জেলা, যেখানে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে। চুনাখোলা মসজিদ পরিদর্শনের পাশাপাশি এখানে ঘুরে দেখা যায় ষাট গম্বুজ মসজিদ, যা বাংলাদেশে ইসলামিক স্থাপত্যের অন্যতম সেরা উদাহরণ। এছাড়াও, খান জাহান আলী (রঃ)-এর মাজার, নয় গম্বুজ মসজিদ, বাগেরহাট জাদুঘর, কচিখালী সমুদ্র সৈকত, চন্দ্রমহল ইকো পার্ক এবং মোংলা বন্দরও দর্শনার্থীদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ।

ষাট গম্বুজ মসজিদ

ষাট গম্বুজ মসজিদ বাগেরহাটের সবচেয়ে পরিচিত ও পর্যটক-প্রিয় স্থান। এটি বাংলাদেশে ইসলামিক স্থাপত্যের একটি অন্যতম প্রতীকী মসজিদ, যার ইতিহাস ও স্থাপত্যশৈলী ভ্রমণপ্রেমীদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। ষাটটি গম্বুজ নিয়ে এই মসজিদটি স্থাপিত হয়েছে বলে এর নাম “ষাট গম্বুজ মসজিদ” রাখা হয়েছে। এটি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

খান জাহান আলীর মাজার

বাগেরহাটের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো খান জাহান আলীর মাজার। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত সুফি সাধক এবং বাগেরহাটের প্রতিষ্ঠাতা। তার মাজার বাগেরহাটে পর্যটকদের একটি বড় আকর্ষণ, এবং এখানে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসে।

উপসংহার

চুনাখোলা মসজিদ শুধু একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, এটি মধ্যযুগীয় বাংলার স্থাপত্যকীর্তির একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। এর ইতিহাস, স্থাপত্যশৈলী এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বের জন্য মসজিদটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে আকৃষ্ট করে। বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে এটি একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন, যা প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ স্থাপত্যশিল্পের সাক্ষ্য বহন করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top