নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জের সুমিলপাড়ায় অবস্থিত আদমজী জুট মিল (Adamjee Jute Mills) ছিল একসময় পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান। এটি শুধু আকারে নয়, প্রভাব এবং অর্থনৈতিক গুরুত্বের দিক থেকেও বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছিল। বিশেষ করে পাটশিল্পের ইতিহাসে এ প্রতিষ্ঠানটিকে প্রাচ্যের ডান্ডি নামে অভিহিত করা হত। তবে সময়ের সাথে সাথে এর ইতিহাসে পরিবর্তন এসেছে। শুরুতে যে মিলটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম ছিল, তা একসময় লোকসানে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে সেখানে আদমজী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল বা আদমজী ইপিজেড গড়ে উঠেছে, যা নতুনভাবে এলাকাটির আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।
আদমজী জুট মিলের প্রতিষ্ঠা ও প্রাথমিক সাফল্য
১৯৫০ সালে, পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী পরিবারের তিন ভাইয়ের উদ্যোগে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে প্রায় ২৯৭ একর জমির উপর আদমজী জুট মিলস প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি পাটকলের ক্ষেত্রে একটি বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল। এক বছরের মধ্যে, ১৯৫১ সালের ১২ ডিসেম্বর, ১৭০০ হেসিয়ান ও ১০০০ সেকিং লুম দিয়ে এ মিলটি বানিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। প্রথমদিকে উৎপাদন কিছুটা কম থাকলেও শেয়ার ছেড়ে দেওয়ার পর প্রায় ৩,৩০০ তাঁতকল বসানো হয়, যা এই শিল্প প্রতিষ্ঠানকে পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তম পাটকল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
পাটশিল্পের স্বর্ণযুগ ও আদমজীর ভূমিকা
১৯৭০ এর দশক ছিল আদমজী জুট মিলের জন্য এক সোনালি সময়। তখন প্লাস্টিক ও পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটজাত পণ্য ব্যবহারের আগ্রহ বাড়ে। এই সময়ের মধ্যে আদমজী পাটকল থেকে বছরে প্রায় ৬০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হত। এর মাধ্যমে শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ পাটজাত পণ্যের চাহিদা মেটানো হত না, বরং বিদেশেও বিপুল পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করা হত। বিশেষ করে চট, কার্পেটসহ উন্নত মানের পাটজাত দ্রব্য বিদেশের বাজারে চাহিদাসম্পন্ন হয়ে ওঠে।
স্বাধীনতার পর পাটশিল্পের অবস্থা
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭১ সালে আদমজী জুট মিলকে জাতীয়করণ করা হয়। জাতীয়করণের পরও এই পাটকল দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি পায় এবং এ খাত থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় অব্যাহত থাকে। কিন্তু ধীরে ধীরে বিভিন্ন কারণের জন্য এ শিল্পটি সমস্যায় পড়তে শুরু করে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়, এবং পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার আরও জনপ্রিয় হতে থাকে, যা পাটশিল্পকে সংকটের মধ্যে ফেলে দেয়।
আদমজী জুট মিলের পতন
নানা জটিলতা, যেমন প্রশাসনিক দুর্বলতা, অপ্রয়োজনীয় লোকবল বৃদ্ধি, দুর্নীতি, এবং কাঁচামালের ঘাটতির কারণে আদমজী জুট মিল ক্রমাগতভাবে লোকসানের সম্মুখীন হতে থাকে। উৎপাদন ক্ষমতা থাকলেও মিলটির দক্ষ ব্যবস্থাপনা না থাকায় লোকসান আরও বাড়তে থাকে। ২০০২ সালের ৩০ জুন, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আদমজী জুট মিলের কার্যক্রম চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতিতে একটি বড় ধাক্কা হিসেবে ধরা হয়েছিল, কারণ এই পাটকল শুধু একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল না, বরং হাজার হাজার শ্রমিকের জীবিকা নির্বাহের একটি প্রধান উৎস ছিল।
আদমজী ইপিজেড নতুন সূচনা
যদিও আদমজী জুট মিল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তবে এর স্থানে নতুন এক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়। ২০০৬ সালের ৬ মার্চ, আদমজী জুট মিলের ১ ও ২ নম্বর ইউনিটে আদমজী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (Adamjee EPZ) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি দেশের রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে গঠিত একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। বর্তমানে এখানে উন্নত অবকাঠামো, যেমন পানি শোধনাগার, বিদ্যুতের জন্য নিজস্ব পাওয়ার প্লান্ট এবং ১১ কেভির একটি সাব ষ্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা আদমজী এলাকার আর্থিক উন্নয়নে সহায়ক হয়েছে।
আদমজী এলাকায় গড়ে ওঠা জনগোষ্ঠী
আদমজী জুট মিল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর, ও সোনারগাঁ অঞ্চলে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর আবাস গড়ে উঠেছে। শিল্প কারখানার পাশাপাশি এখানকার অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবকাঠামোও উন্নত হয়েছে। শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ে গড়ে ওঠা এই জনগোষ্ঠী প্রাথমিকভাবে শিল্প শ্রমিকদের উপর নির্ভরশীল ছিল, তবে বর্তমানে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অন্যান্য পেশাতেও তাদের জড়িত দেখা যায়।
কিভাবে যাবেন আদমজী জুট মিল বা আদমজী ইপিজেডে
ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের আদমজী এলাকায় পৌঁছানো বেশ সহজ। ঢাকার গুলিস্তান থেকে বিভিন্ন বাস সার্ভিস যেমন দোয়েল, স্বদেশ ও বোরাক সরাসরি নারায়ণগঞ্জের ইপিজেড বাস স্ট্যান্ডে নিয়ে যায়। সেখান থেকে কয়েক মিনিটের হাঁটা পথেই আপনি আদমজী এলাকায় পৌঁছে যাবেন, যেখানে বর্তমানে আদমজী ইপিজেড অবস্থিত। এছাড়া, ঢাকা থেকে ট্রেনে করেও নারায়ণগঞ্জে যাওয়া যায়, যা সময়সাপেক্ষ হলেও সুবিধাজনক।
কোথায় খাবেন
আদমজী এলাকা এবং তার আশপাশে বেশ কিছু খাবারের হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট রয়েছে, যা স্থানীয় এবং বাহিরের দর্শনার্থীদের কাছে জনপ্রিয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হোটেল হলো সাথি হোটেল, রেসিপি চাইনিজ, প্রিতুলস ফুড জোন, এবং বিসমিল্লাহ্ বিরিয়ানি হাউজ। এগুলোতে আপনি স্থানীয়, চাইনিজ, এবং বিভিন্ন প্রকার খাবারের স্বাদ নিতে পারবেন।
নারায়ণগঞ্জের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান
নারায়ণগঞ্জ জেলা শুধু আদমজী জুট মিল নয়, এর পাশাপাশি বেশ কিছু ঐতিহাসিক ও পর্যটন স্থানের জন্যও পরিচিত। এখানে কিছু উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান হলো:
- পানাম নগর: মুঘল আমলের অন্যতম প্রাচীন শহর, যা এখন একটি পর্যটন আকর্ষণ।
- জিন্দা পার্ক: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর, যেখানে মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশে বিশ্রাম নিতে আসে।
- মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ী: ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ী, যা একসময় বাংলার জমিদারি ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।
- সোনাকান্দা দুর্গ: মুঘল আমলের ঐতিহাসিক প্রতিরক্ষা স্থাপনা।
- মায়া দ্বীপ: শীতলক্ষ্যা নদীর একটি ছোট দ্বীপ, যা স্থানীয় পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয়।
- বাংলার তাজমহল: আগ্রার তাজমহলের আদলে নির্মিত একটি অনুকরণীয় স্থাপনা।
- গোয়ালদি মসজিদ: মুঘল স্থাপত্যের একটি চমৎকার নিদর্শন, যা এখনও দেখতে পর্যটকরা আসেন।
- লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন: যেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয় এবং বিক্রি হয়।
- ফুলের গ্রাম সাবদি: যা ফুলের জন্য বিখ্যাত, এবং এখান থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ফুল সরবরাহ করা হয়।
উপসংহার
আদমজী জুট মিল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি ছিল শুধুমাত্র একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এ অঞ্চলের হাজারো মানুষের জীবন ও জীবিকার কেন্দ্রবিন্দু। যদিও আদমজী জুট মিল বর্তমানে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে, কিন্তু এর স্থলে গড়ে ওঠা আদমজী ইপিজেড আবারও এলাকাটির অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য, এবং বর্তমান উন্নয়ন কার্যক্রমের দিকে তাকালে বোঝা যায় যে, আদমজী শুধু একটি নাম নয়, এটি বাংলাদেশের শিল্প ইতিহাসের একটি জ্বলন্ত প্রতীক।