ঢাকার ইতিহাস আর সংস্কৃতির সঙ্গে যারা পরিচিত, তাদের কাছে পুরান ঢাকার নাম শুনলেই বহু শতাব্দী পুরনো ঐতিহ্যের ছবি ভেসে ওঠে। এই পুরোনো শহরের বুকেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বড় কাটরা, মুঘল আমলের অন্যতম একটি মহৎ স্থাপনা। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র, শাহজাদা শাহ সুজার নির্দেশে নির্মিত এই স্থাপত্যটি কেবল স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শনই নয়, বরং তা ঢাকা শহরের সমৃদ্ধ ইতিহাসের অন্যতম প্রমাণ।
বড় কাটরার নির্মাণ
১৬৪১ খ্রিস্টাব্দে বড় কাটরার নির্মাণ শুরু হয়, সম্রাট শাহজাহানের আদরের পুত্র শাহ সুজার জন্য। শাহ সুজা তখন বাংলার সুবাহদার ছিলেন। প্রধান স্থপতি মীর আবুল কাসেম এই ভবনটি নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন, যাকে সে সময় “মীর-ই-ইমারত” নামে আখ্যায়িত করা হত। মীর আবুল কাসেমের নেতৃত্বে এই অনন্য স্থাপত্যটি গড়ে ওঠে বুড়িগঙ্গার তীরে। মূলত এটি ছিল রাজকীয় প্রাসাদ, কিন্তু পরবর্তীতে এটি মুসাফিরখানা (ধর্মশালা) হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ভ্রমণকারীরা আশ্রয় গ্রহণ করত।
স্থাপত্য শৈলী বড় কাটরার গঠন এবং নকশা
বড় কাটরার নকশা ছিল অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ। আয়তাকার প্রাঙ্গণ ঘিরে এই প্রাসাদটি গড়ে উঠেছে এবং এখানে মোট ২২টি কক্ষ রয়েছে। প্রাসাদের উত্তরে এবং দক্ষিণে দুটি বড় প্রবেশপথ রয়েছে। এর কেন্দ্রস্থলে রয়েছে একটি তিনতলা উচ্চতার প্রবেশদ্বার, যা মুঘল স্থাপত্যের ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। প্রবেশদ্বারের দুইপাশে দ্বিতল ঘরের সারি এবং প্রবেশদ্বারের দুইপ্রান্তে দুটি আটকোণা বুরুজ (টাওয়ার) রয়েছে যা পুরো স্থাপনাটির চেহারায় অনন্যতা যোগ করে।
বড় কাটরার বাইরের দেয়ালের সৌন্দর্য এবং শৈল্পিকতা দেখে বোঝা যায়, এটি শুধুমাত্র একটি ভবন ছিল না, বরং এটি ছিল সেই সময়ের রাজকীয় সৌন্দর্যের প্রতীক। মুঘল স্থাপত্যশৈলীর দৃষ্টিতে এর প্রতিটি অংশেই এক ধরণের নিখুঁত কারুকার্য রয়েছে যা তৎকালীন শিল্পীদের প্রতিভার অনন্য উদাহরণ।
কিংবদন্তি ও ইতিহাস শাহ সুজার পছন্দ না হওয়া এবং পরিণতি
বড় কাটরার নির্মাণ শেষ হলে, এক কিংবদন্তি অনুসারে, শাহজাদা শাহ সুজা প্রাসাদটি তার প্রয়োজন অনুযায়ী যথাযথ মনে করেননি। যদিও নির্মাণ কাজ অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং সুদৃশ্য ছিল, তবুও সেটি শাহ সুজার মানসিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় তিনি স্থপতি মীর আবুল কাসেমকে শর্তসাপেক্ষে এই স্থাপনাটি ব্যবহারের অনুমতি দেন। শর্তটি ছিল, যারা এই স্থাপনার পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে, তারা যেন কোন অবস্থাতেই এই ওয়াকফ (দানকৃত) স্থাপনাটি ব্যবহারের জন্য ভাড়ার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে না পারে।
বাইশটি দোকানির নিকট এই ওয়াকফ করা দোকানগুলো দিয়ে বড় কাটরার খরচ নির্বাহ করা হত। অর্থাৎ এই দোকানগুলো থেকে কোনো ধরনের ভাড়া বা অর্থ না নিয়ে এটি পরিচালনা করা হত। এটি মুঘল আমলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি উদাহরণ, যেখানে ধর্মীয় এবং দাতব্য কাজকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত।
বড় কাটরার বর্তমান অবস্থা
বিগত কয়েক শতাব্দীর ইতিহাসের সাক্ষী এই বড় কাটরা বর্তমানে কিছুটা ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বহুবার উদ্যোগ নিয়েছে এই ইমারতটিকে সংরক্ষণ এবং সংস্কারের জন্য, কিন্তু তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। বড় কাটরার বর্তমান মালিকানাধীন কর্তৃপক্ষের আপত্তি এবং বিভিন্ন আইনি জটিলতার কারণে এর পুনর্গঠন ও সংরক্ষণ কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে।
বর্তমানে বড় কাটরা হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম মাদ্রাসার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। দর্শনার্থীদের জন্য প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এটি উন্মুক্ত থাকে। যদিও এর প্রাচীন জৌলুস হারিয়ে যেতে বসেছে, তবুও এর ইতিহাস এবং স্থাপত্যশৈলীর আকর্ষণ এখনও মানুষকে মুগ্ধ করে।
বড় কাটরায় ভ্রমণ কীভাবে পৌঁছাবেন
রাজধানী ঢাকার যেকোনো প্রান্ত থেকে পুরান ঢাকা আসা মোটেও কঠিন নয়। বড় কাটরা অবস্থিত চকবাজার এলাকায়, যা ঢাকার প্রাণকেন্দ্রের মধ্যে পড়ে। আপনি ঢাকার যেকোনো স্থান থেকে রিকশা বা সিএনজি নিয়ে সরাসরি বাবুবাজারের দিকে যেতে পারেন, যেখান থেকে বড় কাটরা খুব সহজেই পৌঁছে যাবেন। বড় কাটরা থেকে ছোট কাটরার দূরত্ব মাত্র ১৮৩ মিটার, যা পায়ে হেঁটেই ঘুরে দেখা সম্ভব।
বড় কাটরার ঐতিহাসিক গুরুত্ব
বড় কাটরার ইতিহাস শুধুমাত্র মুঘল স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন হিসেবে সীমাবদ্ধ নয়, এটি মধ্যযুগীয় ঢাকার অর্থনৈতিক, সামাজিক, এবং সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতিফলন। এক সময়ে এটি ছিল ব্যস্ততম বাণিজ্যকেন্দ্র এবং মুসাফিরখানা, যেখানে দেশ-বিদেশ থেকে আসা ব্যবসায়ী এবং পর্যটকরা আশ্রয় নিত।
বর্তমান সময়ে এর বেশিরভাগ অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও, বড় কাটরার প্রাচীন ঐতিহ্য এবং মুঘল স্থাপত্যের ছাপ এখনও স্পষ্টভাবে দেখা যায়। ঢাকা শহরের একসময়ের গৌরবময় ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এই স্থাপনাটি সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি। বড় কাটরার মতো স্থাপনাগুলো আমাদের অতীতের সাথে সংযোগ স্থাপন করে এবং আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অমূল্য অংশ হিসেবে বিবেচিত।
বড় কাটরার আশেপাশের দর্শনীয় স্থান
বড় কাটরা ঘুরতে এলে আশেপাশে আরও বেশ কিছু ঐতিহাসিক এবং আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে যেগুলো ভ্রমণকারীরা পরিদর্শন করতে পারেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো:
১. ছোট কাটরা
বড় কাটরার একদম পাশেই অবস্থিত ছোট কাটরা, যা মুঘল স্থাপত্যশৈলীর আরেকটি অনন্য নিদর্শন। ছোট কাটরা নির্মিত হয়েছিল ১৬৬৪ সালে, মুঘল সুবাহদার শাহ শুজার আমলে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো এবং বড় কাটরার তুলনায় এটি ছোট আকারের হলেও এর স্থাপত্যশৈলী একইভাবে মনোমুগ্ধকর।
২. লালবাগ কেল্লা (Lalbagh Fort)
ঢাকার অন্যতম জনপ্রিয় ঐতিহাসিক নিদর্শন লালবাগ কেল্লা বড় কাটরার খুব কাছেই অবস্থিত। ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র আজম শাহ এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। এটি একটি অসমাপ্ত মুঘল দুর্গ হলেও এর স্থাপত্যের গরিমা এবং চারপাশের বাগান দর্শনার্থীদের বিমোহিত করে।
৩. তারা মসজিদ (Star Mosque)
বড় কাটরার কাছাকাছি অবস্থিত এই মসজিদটি তার অপূর্ব কারুকাজ এবং স্থাপত্যশৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ। মসজিদটির দেয়ালে তারকা আকৃতির টাইলসের নকশা এর নামকরণ করেছে “তারা মসজিদ”।
৪. আহসান মঞ্জিল (Ahsan Manzil)
প্রাসাদতুল্য এই স্থাপনাটি ছিল ঢাকার নবাবদের আবাসস্থল। এটি বর্তমানে একটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং এটি পুরান ঢাকার অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ।
৫. সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল
পুরান ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সদরঘাট হলো ঢাকার প্রধান নৌবন্দর। এখানে প্রতিদিন শত শত যাত্রী নৌযানে চলাচল করে, এবং এটি বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী বড় কাটরার নিকটে একটি অন্যতম জনপ্রিয় স্থান।
উপসংহার
পুরান ঢাকার বড় কাটরা কেবল একটি স্থাপত্যের উদাহরণ নয়, এটি সেই সময়ের সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন। মুঘল আমলের এই স্থাপনাটি ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী। সময়ের পরিক্রমায় এটি কিছুটা ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও, এখনও এর প্রতিটি ইট সেই অতীতের গৌরবকে ধারণ করে আছে। আমাদের বর্তমান প্রজন্মের দায়িত্ব হল এই ধরনের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোকে সংরক্ষণ করা এবং তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টিকিয়ে রাখা।
তাই, যদি আপনি ইতিহাস এবং স্থাপত্যের প্রেমে মগ্ন হন, তাহলে বড় কাটরা ঘুরে আসা আপনার ভ্রমণ তালিকার শীর্ষে রাখা উচিত। ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক নিদর্শন আপনাকে নিয়ে যাবে এক অন্যরকম সময়ের পথে, যেখানে রাজকীয়তা, স্থাপত্যশৈলী এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এক হয়ে মিশে আছে।