খেলারাম দাতার বাড়ি

খেলারাম দাতার বাড়ি

ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার এক নিভৃত পল্লী অঞ্চলে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক এক স্থান, যা খেলারাম দাতার বাড়ি নামে পরিচিত। খেলারাম দাতা, যিনি একসময় এই অঞ্চলের আলোচিত ও বিতর্কিত চরিত্র ছিলেন, তাঁকে নিয়ে স্থানীয় জনপদে প্রচুর লোককথা প্রচলিত। তিনি ছিলেন একজন ডাকাত সর্দার, তবে সেই সঙ্গে দানশীলতার জন্যও তিনি সুপরিচিত। খেলারাম দাতা যেমন তাঁর ডাকাতির ভয়ে মানুষকে কাঁপিয়ে রেখেছিলেন, তেমনি দুঃস্থ ও অসহায় মানুষদের বিপদে সবার আগে তাঁর সাহায্য পৌঁছাতো। এই দ্বৈত চরিত্র তাকে এক রহস্যময় কিংবদন্তিতে পরিণত করেছে।

খেলারাম দাতার বাড়ি ইতিহাস ও লোককথা

খেলারাম দাতার পরিচয় নিয়ে যেমন নানা গল্প প্রচলিত, তেমনই তাঁর বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অজস্র কাহিনী। কথিত আছে, খেলারাম দাতার বাড়ি থেকে ইছামতি নদী পর্যন্ত একটি গোপন সুড়ঙ্গ ছিল, যা তিনি ডাকাতির পর লুট করা সম্পদ নিরাপদে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যবহার করতেন। এই সুড়ঙ্গটি ছিল তাঁর বাড়ির অন্যতম আকর্ষণ এবং রহস্যের আধার। যদিও বর্তমান সময়ে এই সুড়ঙ্গ পথটি সংস্কার করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তবুও এই বাড়িটি আজও স্থানীয় এবং পর্যটকদের কৌতূহলের কেন্দ্রে রয়েছে। খেলারাম দাতার বাড়ি এবং মন্দিরের অবকাঠামো আজও দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যদিও বাড়ির ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই। বাড়ির বাইরের চেহারা, মন্দির এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলির সৌন্দর্য কেবল দূর থেকেই উপভোগ করা যায়।

খেলারাম দাতার পুকুর আরেকটি মর্মান্তিক কাহিনী

খেলারাম দাতার বাড়ির পাশে রয়েছে একটি বিশাল পুকুর। এই পুকুরটির সঙ্গেও জড়িত আছে একটি গভীর দুঃখময় কাহিনী। জনশ্রুতি অনুযায়ী, খেলারাম দাতা একসময় তাঁর মাকে বাঁচানোর জন্য এই পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, এরপর তিনি আর উঠে আসেননি। এই করুণ ঘটনার ফলে খেলারাম দাতা লোককথায় এক দানবীরের পাশাপাশি এক মর্মান্তিক চরিত্র হিসেবে স্থান পেয়েছেন।

খেলারাম দাতার মন্দির ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য

খেলারাম দাতার বাড়ির সঙ্গেই যুক্ত রয়েছে একটি মন্দির, যা তাঁকে স্মরণ করে তৈরি করা হয়েছে। এই মন্দিরটি খেলারাম দাতার প্রতি স্থানীয় মানুষের শ্রদ্ধা এবং তাঁর স্মৃতি ধারণ করে। মন্দিরটি শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক স্থাপনা হিসেবে নয়, স্থানীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অংশ হিসেবেও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন অনেক দর্শনার্থী এই মন্দিরে এসে খেলারাম দাতার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং এই ঐতিহাসিক স্থানের প্রতি তাদের মুগ্ধতা প্রকাশ করেন।

খেলারাম দাতার সুড়ঙ্গ রহস্যময় স্থাপত্য

বাড়ির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো সেই সুড়ঙ্গ পথ, যা একসময় বাড়ি থেকে ইছামতি নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। জনশ্রুতি অনুসারে, এই সুড়ঙ্গ পথই ছিল খেলারাম দাতার গোপন সম্পদ সংরক্ষণের মূল মাধ্যম। যদিও বর্তমানে এই সুড়ঙ্গটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং এটি পর্যটকদের জন্য নিষিদ্ধ, তবুও এই সুড়ঙ্গ ঘিরে কৌতূহল এবং রহস্যের জাল আজও কাটেনি। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, এই সুড়ঙ্গ পথ অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং তা স্থানীয় জনগণের মধ্যেও এক সময় ভয়ের উদ্রেক করতো। সুড়ঙ্গটির অস্তিত্ব আজও খেলারাম দাতার অতীত জীবনের প্রতি এক অনন্য সাক্ষী হিসেবে রয়ে গেছে।

কিভাবে যাবেন খেলারাম দাতার বাড়িতে?

খেলারাম দাতার বাড়িতে যেতে হলে ঢাকার গুলিস্তান থেকে সরাসরি বাসে বান্দুরা যাওয়া সম্ভব। বান্দুরার রাস্তা ধরে কিছুদূর গেলেই নবাবগঞ্জের ঐতিহাসিক এই স্থানে পৌঁছানো যায়। ঢাকার বাবুবাজার ব্রিজ অথবা শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতু (৩য় বুড়িগঙ্গা সেতু) দিয়েও সহজেই দোহারের পথ ধরে নবাবগঞ্জে যাওয়া যায়। নবাবগঞ্জের কলাকোপা থেকে বান্দুরার দিকে যাওয়ার পথ ধরলেই খেলারাম দাতার বাড়ির সন্ধান মেলে। বাড়িটি পৌঁছানোর জন্য সহজ এবং সুগম রাস্তা থাকায় এটি ভ্রমণকারীদের জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক।

থাকার ব্যবস্থা দিনের মধ্যে ফিরুন

খেলারাম দাতার বাড়ি রাজধানী ঢাকার খুব কাছেই অবস্থিত হওয়ায় এখানে গিয়ে দিনে ভ্রমণ করে আবার একই দিনে ফিরে আসা সম্ভব। তাই থাকার প্রয়োজন নেই। তবুও, যাঁরা স্থানীয় এলাকায় আরও কিছুটা সময় কাটাতে চান বা অন্যান্য দর্শনীয় স্থান দেখতে চান, তাঁদের জন্য ঢাকার বিভিন্ন হোটেল বা অতিথিশালায় থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাছাড়া, স্থানীয় পর্যটকদের জন্য কিছু ছোটো অতিথিশালাও পাওয়া যায়।

আশেপাশের দর্শনীয় স্থান স্থানীয় ঐতিহ্যের অংশ

খেলারাম দাতার বাড়ি ঘিরে রয়েছে আরও কিছু উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। এর মধ্যে অন্যতম হলো কোকিলপেয়ারী জমিদার বাড়ি, বৌদ্ধ মন্দির, শ্রীলোকনাথ সাহা বাড়ি, কলাকোপা আনসার ক্যাম্প, উকিল বাড়ি, দাস বাড়ি এবং আদনান প্যালেস। এছাড়াও, এখান থেকে ইছামতী নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। নবাবগঞ্জ অঞ্চলের এই ঐতিহাসিক এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মিলনস্থল পর্যটকদের জন্য অনন্য অভিজ্ঞতা প্রদান করে।

খেলারাম দাতা একজন বিতর্কিত কিংবদন্তি

খেলারাম দাতা একজন জটিল ও রহস্যময় ব্যক্তিত্ব হিসেবে ইতিহাসে নিজের স্থান করে নিয়েছেন। ডাকাতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করার পাশাপাশি, তাঁর দানশীলতার জন্যও তিনি বিখ্যাত ছিলেন। খেলারাম দাতা কেবল একজন ডাকাত সর্দারই ছিলেন না, বরং তাঁর জনহিতকর কার্যাবলী এবং দুঃস্থদের প্রতি সহানুভূতি তাঁকে এলাকায় একজন মিশ্র চরিত্রে পরিণত করেছিল। তাঁর কর্মকাণ্ডের কারণে একদিকে যেমন মানুষের মনে ভয় ছিল, অন্যদিকে তেমনি তাঁর দানশীলতা তাঁকে মানুষের হৃদয়ে স্থান দিয়েছিল।

উপসংহার

খেলারাম দাতার বাড়ি ও এর আশেপাশের এলাকা ইতিহাস এবং লোককথার এক অপরূপ সংমিশ্রণ। এই স্থানটি শুধু পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় নয়, বরং ইতিহাসবিদ এবং গবেষকদের কাছেও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। খেলারাম দাতার জীবনের রহস্যময় দিক, তাঁর বাড়ি এবং সুড়ঙ্গ পথের কাহিনী, তাঁর দানশীলতা এবং তাঁর ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা লোককথা—সব মিলিয়ে এই স্থানটি এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক। পর্যটকরা শুধু এই বাড়ির ইতিহাসের সাথে পরিচিত হন না, বরং স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করার সুযোগ পান।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top