পুরান ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত আর্মেনিয়ান চার্চ শুধু একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, বরং এটি ঢাকার ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের একটি মূল্যবান অংশ। এই গীর্জাটি ১৭৮১ সালে নির্মিত হলেও আর্মেনীয়দের ঢাকায় আগমন এবং স্থায়ী বসতি স্থাপনের ইতিহাস অনেক পুরনো। আর্মেনিয়ান চার্চ আরমানিটোলা এলাকায় অবস্থিত, যা একসময় আর্মেনীয় বণিকদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এই স্থাপনা ঢাকার অন্যতম প্রাচীন ইউরোপীয় স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়।
আর্মেনিয়ানদের আগমন ও ব্যবসায়িক প্রভাব
অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে আর্মেনীয় বণিকরা ব্যবসার উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসতে শুরু করে। তারা প্রথমে লবণের ব্যবসায়ে যুক্ত থাকলেও পরবর্তী সময়ে পাট, বস্ত্র এবং পান পাতা রপ্তানির মাধ্যমেও বিশাল বাণিজ্যিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আর্মেনীয়দের আসল উদ্দেশ্য ছিল মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা অন্বেষণ করা। তাদের আগমন ঢাকার অর্থনীতির উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং আর্মেনিটোলা এলাকাটি তাদের কার্যক্রমের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। সেই সময় আর্মেনীয়রা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে তাদের ব্যবসার সুবিধার্থে বসতি স্থাপন করেছিল, কারণ নদীপথে পণ্য পরিবহন ছিল অত্যন্ত সুবিধাজনক।
আর্মেনিয়ান চার্চের প্রতিষ্ঠা এবং আর্কিটেকচার
১৭৮১ সালে নির্মিত এই গির্জাটি মূলত আর্মেনীয় ধর্মযাজক ও বণিকদের দ্বারা স্থাপিত হয়। গির্জাটি প্রতিষ্ঠার পেছনে অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন আগা ক্যাটচিক মিনাস, যিনি গির্জার জন্য জমিটি দান করেন। তার দানের মাধ্যমে আর্মেনিয়ান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে এই গির্জাটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
চার্চটি ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত হয়েছে। এর সামনের দিকে মার্বেল পাথরের বড় দরজা, ভেতরের প্রশস্ত স্থান এবং সিমেট্রিকাল নকশা এটির স্থাপত্যশৈলীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। চার্চের ভেতরে প্রবেশ করলে বাঁদিকে একটি পেঁচানো কাঠের সিঁড়ি রয়েছে যা সরাসরি চার্চের ছাদে উঠে গেছে। চার্চের ডানে নারী ও শিশুদের বসার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং বাঁ-পাশে পুরুষদের বসার স্থান নির্ধারিত হয়েছে। এর মূল বেদীতে যিশুখ্রিস্টের চিত্র এবং ক্রুশচিহ্ন আঁকা হয়েছে, যা গির্জার আধ্যাত্মিকতা প্রতিফলিত করে।
কবরস্থান ও আর্মেনিয়ানদের ঐতিহ্য
আর্মেনিয়ান চার্চের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে এর কবরস্থান। এখানে তিন শতাধিক কবর রয়েছে, যার অধিকাংশই মার্বেল পাথরে তৈরি এবং প্রতিটি কবরের নকশায় বৈচিত্র্য রয়েছে। এই কবরস্থানে ঢাকার আর্মেনিয়ান সমাজের বিভিন্ন সদস্যের কবর রয়েছে, যারা এখানে বাণিজ্য এবং বসতি স্থাপনের মাধ্যমে নিজেদের জীবনের অবসান ঘটিয়েছেন।
এখানে সবচেয়ে প্রাচীন কবরটি ১৭১৪ সালে খোজা এভিয়েটেস লেজারের। তিনি লেজার অফ এরিভানের সন্তান ছিলেন এবং তার মৃত্যুর পর তাকে তেজগাঁওয়ের কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। এই কবরটি প্রমাণ করে যে আর্মেনিয়ানরা ঢাকায় প্রায় ৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করে আসছে। এছাড়াও ১৮৭৭ সালে প্রয়াত ক্যাটচিক এভিটিক থমাসের কবরটি অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। থমাসের স্ত্রী তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে কলকাতা থেকে একটি শ্বেতপাথরের নারীমূর্তি এনে এখানে স্থাপন করেছিলেন।
আর্মেনিয়ান চার্চে শেষ সমাহিত ব্যক্তি হলেন ভেরোনিকা মার্টিন, যিনি ২০০৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার স্বামী মাইকেল জোসেফ মার্টিন ১৯৮৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত চার্চটির দেখাশোনা করতেন এবং ঢাকায় একমাত্র আর্মেনীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন। ২০১৪ সালে তিনি ঢাকা ছেড়ে চলে যান এবং ২০২০ সালে কানাডায় মৃত্যুবরণ করেন।
আর্মেনিয়ান চার্চের আধুনিক প্রেক্ষাপট
বর্তমানে আর্মেনিয়ান চার্চ তার প্রাচীন জৌলুস হারালেও এটি ঢাকার ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে পরিচিত। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে আর্মেনিয়ান চার্চ ঢাকায় আর্মেনিয়ান বণিকদের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করেছে। যদিও বর্তমানে ঢাকায় আর্মেনীয় সম্প্রদায়ের সংখ্যা নেই বললেই চলে, তবে এই গির্জাটি তাদের অবদানের একটি স্মারক হিসেবে টিকে আছে।
আশেপাশের দর্শনীয় স্থান
আর্মেনিয়ান চার্চে ভ্রমণের পর এর আশেপাশে আরো বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে যা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। সদরঘাট, আহসান মঞ্জিল, বিউটি বোর্ডিং, বাহাদুর শাহ পার্ক, লালবাগ কেল্লা এবং তারা মসজিদ এর মধ্যে অন্যতম। পুরান ঢাকার এসব স্থাপনা ইতিহাস এবং স্থাপত্যের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর্মেনিয়ান চার্চে ভ্রমণের সময় এইসব স্থানও ঘুরে দেখা যেতে পারে, যা ঢাকার সমৃদ্ধ ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার একটি সুযোগ এনে দেয়।
সদরঘাট
পুরান ঢাকার সদরঘাট নদীর তীরবর্তী একটি জনপ্রিয় নৌবন্দর। এটি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত এবং এখান থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নৌপথে যাতায়াত করা হয়। সদরঘাটে নদীর কোল ঘেঁষে ঢাকার সজীবতা অনুভব করা যায়। এখানে নৌযানগুলির কোলাহল, ব্যস্ততা এবং নদীর পাড়ের পরিবেশ ঢাকার আদি রূপের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।
আহসান মঞ্জিল
আর্মেনিয়ান চার্চ থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত আহসান মঞ্জিল ঢাকার অন্যতম ঐতিহাসিক স্থাপনা। এটি ছিল নবাবদের প্রাসাদ, যা বর্তমানে একটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যশৈলী এবং নবাবদের জীবনের নানা স্মারক আহসান মঞ্জিলে প্রদর্শিত হয়।
বিউটি বোর্ডিং
বিউটি বোর্ডিং ছিল একসময় ঢাকার সাহিত্যিকদের মিলনস্থল। অনেক বিখ্যাত সাহিত্যিক এবং কবি এখানে বসে সাহিত্যচর্চা করেছেন। এর নিরিবিলি পরিবেশ এবং পুরনো স্থাপত্য ঢাকার সাহিত্যিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরে।
লালবাগ দুর্গ
পুরান ঢাকার আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্থাপনা হলো লালবাগ দুর্গ। এটি মোগল সাম্রাজ্যের সময় নির্মিত একটি অসমাপ্ত দুর্গ। এর মধ্যে রয়েছে একটি মসজিদ, সমাধি এবং একটি দরবার হল। লালবাগ কেল্লার মনোরম পরিবেশ এবং স্থাপত্যশৈলী পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
তারা মসজিদ
পুরান ঢাকার আরেকটি অনন্য স্থাপনা হলো তারা মসজিদ। এর গম্বুজ এবং দেয়ালে তারার নকশা করা রয়েছে, যা এর নামকরণের পেছনে কারণ। এই মসজিদটি ঢাকার ইসলামি স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নিদর্শন।
কিভাবে যাবেন
আর্মেনিয়ান চার্চ পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় অবস্থিত, যা ঢাকার যেকোনো স্থান থেকে সহজেই পৌঁছানো যায়। রাজধানীর গুলিস্থান থেকে রিকশা বা সিএনজি নিয়ে খুব সহজেই এই গির্জায় পৌঁছানো যায়। এছাড়াও ব্যক্তিগত গাড়ি বা গণপরিবহন ব্যবহার করেও এখানে আসা সম্ভব।
উপসংহার
আর্মেনিয়ান চার্চ কেবল ঢাকার একটি প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনা নয়, এটি ইতিহাসের একটি জীবন্ত স্মৃতি। ঢাকায় আর্মেনীয়দের উপস্থিতি এবং তাদের অবদানের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে এই চার্চ। সময়ের সাথে সাথে আর্মেনিয়ান সম্প্রদায় ঢাকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও তাদের এই স্থাপত্য নিদর্শন ঢাকার ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় অংশ হিসেবে থেকে যাবে। যারা পুরান ঢাকার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে চান, আর্মেনিয়ান চার্চ তাদের জন্য একটি অবশ্যই দর্শনীয় স্থান।